দেশের দ্রব্যমুল্য নিয়ন্ত্রণে শুধু সরকারকে দোষলেই হবেনা, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে সাধারণ জনগণকে। মানষিকতার পরিবর্তন সৃষ্টি হতে হবে ব্যবসায়ীদের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। সরকার পক্ষ থেকে অনেকেই বলেছেন, সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। রমজান মাস ও ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে পণ্য মজুত করে, পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অধিক লাভের আশায় সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে ফেলে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দেখা যায়, যেকোন উত্সবকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম কমান। তারা পণ্যের দামে ছাড় প্রদান করেন। ব্যবসায়ীদের এমন পদক্ষেপ পণ্য ও ব্যবসায়ীদের প্রতি ভোক্তাদের আস্থার যায়গা সৃষ্টি করে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সারা বছর যাদেরকে উপর নির্ভর করে ব্যবসা পরিচালিত হয় উৎসব মুহুর্তে তারা যেন উৎসবে স্বতঃস্ফূর্ত শামিল হতে পারেন। সে তাড়না থেকে ব্যবসায়ীরা মূলত পণ্যের দাম কমিয়ে আনার পাশাপাশি বিভিন্ন ছাড় প্রদান করে থাকেন।
অপরদিকে, আমাদের দেশে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ ধরনের মানষিকতা কখনোই দেখা যায়না। এমনকি করোনা মহামারিসহ আমাদের দেশের বিভিন্ন দুর্যোগ মুহুর্তে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অধিক মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার প্রবনতা।
২০২৪ সালে রমজান উৎসবকে কেন্দ্র করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। দ্রব্যমুল্য নিয়ন্ত্রনে এবার মাঠ চষে বেড়ান সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা। তাদের পক্ষ থেকে আসে নানান প্রতিশ্রুতি। বাজার মনিটরিংয়ের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আসে বিভিন্ন নির্দেশনা। কিন্তু ফলাফলে হিসেব নিকেশের কোনই পরিবর্তন নেই। রমজানের শুরুতেই সরকারের প্রানী ও পশু সম্পদ মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে রাজধানীর ৫ টি স্থায়ী ও ২৫টি অস্থায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নায্যমুল্যে গরুর মাংস, মুরগী, মাছ ও দুধ-ডিম বিক্রি করা হলেও প্রশ্ন থেকে যায় দেশের কত শতাংশ মানুষ এই কার্যক্রমের আওতায় উপকৃত হচ্ছেন। এই সংকট নিরসনে প্রয়োজন সরকারের সুদুরপ্রসারিত পরিকল্পনার।
বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের পেছনের শক্তি গুলোকে যতদিন চিহ্নিত করে কঠর ব্যাবস্থা গ্রহন করা না হবে ততোদিন দেশে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব না।
ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সরকারের পাশাপাশি দাঁড়াতে হবে দেশের সুশীল সমাজকে। দেশের প্রচলিত আইনে ভোক্তাদের অধিকার প্রাপ্তিতে আরো কঠর ভাবে কাজ করতে হবে শংশ্লিষ্টদের। তবেই দেখা যাবে, ব্যবসায়ীরা তাদের উত্পাদিত পণ্য কিংবা আমদানিকৃত পণ্যের দাম নির্ধারণে হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হবে।
দ্রব্যমুল্য নিয়ন্ত্রনে, সরকারের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি ক্রেতাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে সরকারী ভাবে প্রচারণার মাধ্যমে সচেতন করতে হবে। প্রতিটি ভোক্তাকে কোন পণ্য ক্রয়ের পূর্বে পণ্যের মোড়কে, সংশ্লিষ্ট পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য, উত্পাদনের তারিখ, প্যাকেটজাতকরণের মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ ও মূল্য রসিদ গ্রহণান্তে মালামাল সংগ্রহের বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে। সেই সাথে ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কেও ভোক্তাদের ধারনা ও করনীয় বিষয়ে জানতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের অধীন সকল অপরাধ জামিনযোগ্য, আমলযোগ্য ও আপসযোগ্য বটে। তবে এই আইনের কিছু ধারা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা আবশ্যক। যেমন, ৩৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো আইন বা বিধি দ্বারা আরোপিত বাধ্যবাধকতা অমান্য করে তার দোকান বা প্রতিষ্ঠানের সহজে দৃশ্যমান কোন স্থানে পণ্যের মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করে সেই অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩৯ ধারায় বলা আছে, আইন বা বিধি দ্বারা আরোপিত বাধ্যবাধকতা অমান্য করে তার দোকান বা প্রতিষ্ঠানের সেবার মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ না করলে এবং সংশ্লিষ্ট স্থানে বা সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে উক্ত তালিকা প্রদর্শন না করলে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
একইভাবে ৪০ ধারায় উল্লেখিত রয়েছে, ধার্য্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় করিবার দ-। সেখানে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি কোন আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোন পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদ-, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদ-, বা উভয় দ-ে দ-িত হইবেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রতারক ব্যবসায়ীরা লঘুদন্ডে দন্ডিত হয়ে পরক্ষনেই একই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজন বোধে এই আইন সংসধোন করে আরো কঠর শাস্তির ব্যাবস্থা আনতে হবে এবং তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
ভোক্তা অধিকার আইনটি জনগণ যদি প্রকৃত অর্থেই অনুশীলন করে, তাহলে ব্যবসায়ীদের কোনো কারণ ব্যতিরেকে মূল্যবৃদ্ধির চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া উপায় থাকবে না।
দেশের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই দেখা যায়, দোকানের মালিকরা কোনো ধরনের নিয়ম অনুসরণ না করেই সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে পণ্য বিক্রি করে থাকে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্যও বিক্রি করছে দেদারসে। মোড়কে উল্লেখিত মূল্যে থেকে অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করছে অনেক ব্যবসায়ীরা।
সর্বোপরি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য হতে হবে, যেখানে অনিয়ম দেখা যাবে সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে এবং ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হবে। তাছাড়া যারা পণ্যের মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সরকার ঘোষণা প্রদান করেছে অনিয়মের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণু নীতির। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি অবৈধ ও প্রতারক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত নীতিমালা কার্যকরভাবে প্রয়োগ ঘটিয়ে সাধারণের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাবে। স্থানীয় বাজার ও স্ব স্ব অঞ্চলে প্রতারক ব্যবসায়ীদের প্রতিহত করতে সামাজিক মুল্যবোধের যায়গাথেকে সরকারকে সহযোগীতা করতে হবে দেশের জনগণকেই।